মারকাযুত তাকওয়া ওয়াদ দিরাসাতিল ইসলামিয়া: প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মুফতি এবিএম কামরুজ্জামান ভূঁইয়া আল কাসেমী

একজন আলেম, শিক্ষক, সমাজসেবক ও আধ্যাত্মিক সাধক

জন্ম ও শৈশব

১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানার ইসলামপুর (বালিসীতা) গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ভূঁইয়া বাড়ির সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন মুফতি এবিএম কামরুজ্জামান ভূঁইয়া আল কাসেমী। তাঁর পিতা ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষক মাস্টার মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ ভূঁইয়া। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশব থেকেই শান্ত স্বভাব, জ্ঞানপিপাসা ও আলাদা ধরনের প্রতিভা তাঁর চারপাশের সবার দৃষ্টি কেড়েছিল।


প্রাথমিক শিক্ষা

পরিবারের শিক্ষামুখর পরিবেশে বড় হতে হতে তিনি খুব অল্প বয়সেই জ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগে আবদ্ধ হন। আরবি শিক্ষার হাতেখড়ি হয় দাদাজানের প্রতিষ্ঠিত জামিয়া গাফুরিয়া ইসলামপুর মাদ্রাসার মক্তবে। একই সাথে বাবার কর্মস্থল কাঁকনহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং কেন্দ্রীয় প্রাইমারি সমাপনী পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করেন।
এরপর জামিয়া গাফুরিয়ার হিফজ বিভাগে ভর্তি হয়ে যুগশ্রেষ্ঠ হাফেজ ছমিরুদ্দিন সাহেবের প্রিয় শিষ্যে পরিণত হন। এ সময়ে তাঁর বুদ্ধিমত্তা, অধ্যবসায় ও প্রখর স্মৃতিশক্তি সবার প্রশংসা কুড়ায়।


উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা

ইলমে দ্বীনের প্রতি গভীর টান তাঁকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্ঞানের সোপান অতিক্রম করতে উদ্বুদ্ধ করে। • প্রাথমিক পাঠ শেষ করে শায়খুল হাদীস মরহুম আমির উদ্দিন সাহেবের পরামর্শে চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ মেখল হামিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় ফার্সি বিভাগসহ ছয় বছর অধ্যয়ন করেন।

• পরে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম হাটহাজারীতে দীর্ঘ চার বছর ধরে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পর্যন্ত পাঠ সমাপন করেন।

• ১৯৯৫ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে স্কলারশিপ লাভ করে তাকমীলুল হাদীস কোর্স সমাপ্ত করেন।

• মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পারিবারিক স্বপ্ন সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতায় পূর্ণ না হলেও তিনি অদম্য দৃঢ়তায় ঢাকার মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ায় দুই বছরব্যাপী আত-তাখাসসুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ফিকহে হানাফীর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।


কর্মজীবন

১৯৯৮ সালের শেষ দিকে উস্তায মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের নির্দেশে তিনি জামিয়া ইসলামিয়া বাইতুল ফালাহ, মোহাম্মদপুর, ঢাকায় যোগ দেন। সেখানে প্রথমে অধ্যাপনা ও সহকারী শিক্ষাসচিব হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি সিনিয়র মুহাদ্দিস পদে আসীন হন, যা তিনি আজও সগৌরবে পালন করে যাচ্ছেন।
২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি মোহাম্মদপুর মোহাম্মদী হাউজিং-এর কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদে নূর-এর ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর নেতৃত্বে এ মসজিদ পরিণত হয়েছে আস্থা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীকে।

তিনি দ্বীনি শিক্ষার প্রসার ও নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝে ইলমের আলোক ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন দুটি প্রতিষ্ঠান—
• মারকাযুত তাকওয়া ওয়াদ্দিরাসাতিল ইসলামিয়া (বালক বিভাগ)
• জামিয়াতুত তায়্যিবাত (বালিকা বিভাগ)

> তিনি জামিয়া মুহাম্মাদিয়া মোহাম্মদপুর, জামিয়া গাফুরিয়া ময়মনসিংহসহ বহু মাদ্রাসার উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখছেন। তার দেখানো পথ ধরে এই অঞ্চলগুলো পেয়েছে দীনের আলোর দিশা। একই সাথে তিনি হুফফাজুল কুরআন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর মোহাম্মদপুর থানা শাখার সভাপতি।

> হজ্ব প্রশিক্ষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি সুপরিচিত। ২০০৭ সাল থেকে তিনি মসজিদে নূরে প্রতি বছর পাঁচ দিনব্যাপী হজ্ব প্রশিক্ষণের আয়োজন করছেন, যা অসংখ্য হাজিদের জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে।

> তাঁর সেবাধর্মিতার আরেক দিক হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা। তিনি এক সময় আল খায়ের কর্পোরেশন লিমিটেড-এর পরিচালক পর্ষদের সদস্য ছিলেন এবং বর্তমানে ইনসাফ ফাউন্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


সাহিত্য ও গবেষণা

দ্বীনের সঠিক ধারণা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই তিনি কলম হাতে নিয়েছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রাহবারে হজ্ব ও দলীলসহ তারাবির নামাজ পাঠকমহলে বিশেষ সমাদৃত হয়েছে। এছাড়াও তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ আরবি ও উর্দু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন, যেগুলোর কিছু প্রকাশিত, আর কিছু প্রকাশের অপেক্ষায়।


আধ্যাত্মিকতা

ইলমের পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায়ও অগ্রসর। তিনি একজন দ্বীনের দায়ী এবং বিশেষ ইজাযতপ্রাপ্ত খলিফা। তাঁর মুরুব্বী আরেফ বিল্লাহ হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন বিন হুসাইন (দামাত বারাকাতুহুম), পীর সাহেব ঢালকানগর, ঢাকা। তাঁর আধ্যাত্মিক নির্দেশনায় তিনি তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হয়েছেন এবং অসংখ্য মুরিদ-শাগরেদের জীবনকে ঈমানি আলোয় আলোকিত করে চলেছেন।

মুফতি এবিএম কামরুজ্জামান ভূঁইয়া আল কাসেমী শুধু একজন আলেমই নন, বরং তিনি একাধারে শিক্ষক, সমাজসেবক, লেখক, প্রশিক্ষক ও আধ্যাত্মিক সাধক। তাঁর জীবন সংগ্রাম, শিক্ষার প্রতি নিষ্ঠা এবং দ্বীনের সেবায় আত্মনিয়োগ আগামী প্রজন্মের জন্য এক অনন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।